• বৃহস্পতিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ||

  • আশ্বিন ১৩ ১৪৩০

  • || ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

দৈনিক খাগড়াছড়ি

নৈশ প্রহরী উহ্লাচিং এর বিশ্ববিদ্যালয় জয়

দৈনিক খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০২৩  

আরো অনেক দূর যেতে চান উহ্লাচিং মারমা।

আরো অনেক দূর যেতে চান উহ্লাচিং মারমা।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হন তাঁর বাবা। একসময় পড়ে যান বিছানায়। তখন থেকে ছোট বোনের পড়াশোনা, সংসারের খরচ—বলতে গেলে একাই সামলাতে হচ্ছে উহ্লাচিং মারমাকে। রাত জেগে পাহারা দিতেন খাগড়াছড়ি জেলা জজকোর্ট। দিনে পড়তেন। এভাবেই সুযোগ পেয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আজ ডিউটি নেই?

‘আছে, রেডি হচ্ছি।
কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছে। কারেন্টও খুব ঝামেলা করছে। আসে আর যায়।

আজ টর্চলাইটটা ঠিকমতো চার্জ দিতে পারিনি। তাই বের হতে একটু দেরি হচ্ছে।’ মুঠোফোনের ওপাশ থেকে বলছিলেন উহ্লাচিং মারমা। গেল মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার মতো বাজে।

একটু পরেই শুরু হবে ডিউটি। তাই টর্চলাইট, লাঠি, বাঁশিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রতিদিনের মতো রাত জেগে পাহারা দেবেন খাগড়াছড়ি জেলা জজকোর্ট। সেখানকার নৈশ প্রহরী তিনি।

বাবাও নৈশ প্রহরী ছিলেন

বাড়ি তাঁর খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি গ্রামে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়েছেন। এরপর সিঙ্গীনালার মগপাড়ায় দিদিমার বাড়িতে থাকতেন। সেখানকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তৃতীয় শ্রেণিতে।


বাবা থৈঅং মারমা নৈশ প্রহরী। অস্থায়ী চাকরি। উহ্লাচিং তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। হঠাৎ একদিন খবর পেলেন তাঁর বাবা গুরুতর অসুস্থ। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। ডাক্তার জানালেন, তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। ডিস্কগুলো অস্বাভাবিক রকম ফাঁকা হয়ে কিছু মাংস পর্যন্ত ঢুকে গেছে! কয়েক মাস ভর্তি ছিলেন খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন ডাক্তার। নিজেদের ফসলি জমি বিক্রি এবং মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে ভারতের চেন্নাইয়ে গেলেন। মাসখানেক পর ভারত থেকে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফেরেন থৈঅং মারমা।

এখন চলবেন কী করে?

ডাক্তার বলেছেন, আধাঘণ্টার বেশি দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা যাবে না। ফলে চাকরি ছাড়লেন। অনটনের কারণে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছিল। উহ্লাচিং টিউশনি করেই এসএসসির ফরম ফিলাপ করেছিলেন। কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন নিজের টাকায়। এদিকে পাওনাদাররা টাকার জন্য নানা কথা শোনাচ্ছিল। ঘরেও অভাব হাঁ করে আছে। এক পর্যায়ে ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করে থৈঅং মারমা আবার নৈশ প্রহরী হিসেবে কাজ শুরু করলেন। উহ্লাচিং সবে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। একদিন ক্লাস করার সময় খবর পেলেন বাবা স্ট্রোক করেছেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না উহ্লাচিংয়ের মা উক্রা মারমা। পরে নিজেদের অবশিষ্ট জমিটুকু বন্ধক দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করালেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার কয়েক মাস পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন থৈঅং মারমা। এবার প্যারালিসিসে আক্রান্ত হয়ে একেবারে বিছানায়।

যেন সোনার হরিণ

উহ্লাচিং বলছিলেন, ‘কী করব কিছুই মাথায় আসছিল না। বাবা বিছানায়। ঘরে মা আর বোন। তিনটা মুখের আহার কোথা থেকে আসবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’ পরে এক প্রতিবেশীর পরামর্শে গেলেন জজকোর্টে। তাঁর বাবার কর্মস্থলে। কাকুতি-মিনতিতে মন গলে কর্তৃপক্ষের। বাবার চাকরিটা ছেলেকে দিতে রাজি হয়। তবে অস্থায়ী। বললেন, ‘বাবার অফিস কর্তৃপক্ষ আমাকে চাকরিটা যখন দিল মনে হলো, দারোয়ানের চাকরি নয়, যেন সোনার হরিণ হাতে পেয়েছি।’

বিকেল ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ডিউটি। বগলে লাঠি আর হাতে টর্চ নিয়ে রাত জেগে পাহারা দিতেন। বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ার ছিল। ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে সেখানে বসে বিশ্রাম নিতেন। সারা রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সকালে এসে ঘুমিয়ে যেতেন। ক্লান্ত শরীরে পড়ায় মন বসত না। নিয়মিত ক্লাসও করতে পারতেন না। গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীত—ঋতু বদল হলে উহ্লাচিংয়ের এই রুটিনে কোনো বদল হতো না। ‘শুরুর দিকে বাবা খাগড়াছড়ি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মা রাতে তাঁর সঙ্গে থাকতেন। রাতভর ডিউটি করে সকালে দিদিমার বাড়িতে গিয়ে খেতাম। মা-বাবার জন্য খাবার নিয়ে আবার যেতাম হাসপাতালে’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছিলেন উহ্লাচিং। মাস শেষে ১৪ হাজার টাকা পেতেন। তিন হাজার টাকা রেখে বাকিটা মায়ের হাতে তুলে দিতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু এখনো অনিশ্চয়তার মেঘ কাটেনি। পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি সংসার কিভাবে চলবে—এই দুশ্চিন্তা ভর করছে মনে।

- উহ্লাচিং মারমা

এভাবে চলবে না

কলেজে নিয়মিত যেতেন না। পড়াশোনা লাটে ওঠার দশা। প্রতিবেশীরাও উহ্লাচিংয়ের মাকে বলেছিল, ছেলেকে আর পড়ানো ঠিক হবে না। আজকাল পড়াশোনা করে লাভ নেই। উহ্লাচিং ভাবলেন, এভাবে চলতে থাকলে এইচএসসিতে নির্ঘাত ফেল করে বসবেন। প্রতিবেশীদের কটুবাক্য শুনে জেদ চেপে গেল। মনে মনে বললেন, ‘যত সমস্যাই আসুক না কেন, আমাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।’

তখন থেকে জজকোর্টে যাওয়ার সময় বই নিয়ে যেতেন। রাতে ডিউটির ফাঁকে সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসতেন। কোন কোন অধ্যায়ে নিজের দুর্বলতা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করতেন। এইচএসসির দুই মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রীতিময় ত্রিপুরার কাছে পড়া বুঝে নিতেন। বললেন, ‘অল্প সময়ে কিভাবে পড়া শেষ করতে হয় সেটা শিখিয়েছেন প্রীতিময় দাদা। স্বপ্ন দেখিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের।’ জিপিএ ৪.৫০ নিয়ে এইচএসসি পাস করলেন।

কোর্টের বারান্দায় বসে কাঁদতেন

এইচএসসির পর মা-বাবাকে গিয়ে বললাম, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই।’ শুনে তাঁদের মুখ কালো হয়ে গেল! কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে তো চাকরি ছাড়তে হবে। তাহলে সংসার চলবে কী করে—এই দুশ্চিন্তা পেয়ে বসল। তাঁদের মুখের দিকে চেয়ে সেবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম পর্যন্ত পূরণ করেননি।

উহ্লাচিংয়ের খুব খারাপ সময় গেছে তখন। সহপাঠীরা স্বপ্ন দেখছেন বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আর উহ্লাচিং রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। বললেন, ‘চোখের সামনে নিজের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে দেখে খুব খারাপ লেগেছে। গভীর রাতে কোর্ট সুনসান থাকত। তখন বারান্দায় বসে চোখের জল ফেলতাম।’ তবে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। ডিউটির পর মা-বাবার অগোচরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তম নামে এক ছাত্রের কাছে পড়তে যেতেন। কিছুদিন পর তা জানাজানি হয়ে গেল। মা বললেন, ‘আমি জানি, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাও, কিন্তু কী করব। এখনো ধারদেনা পরিশোধ করা যায়নি। তোমার বাবার অবস্থাও ভালো না।’ অগত্যা রণেভঙ্গ দিলেন উহ্লাচিং।

আবার এলো সুযোগ

এবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল উহ্লাচিংয়ের। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পারবি না। তবে চাইলে গুচ্ছ (সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা) পরীক্ষার ফরম তুলে রাখতে পারিস।’ বন্ধুর কথা শুনে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে লাগলেন। বাড়ি গিয়ে একদিন বললেন, ‘বাবা, এবার আমি শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে দেখব।’ শুনে তিনি উহ্লাচিংয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পরে বললেন, ‘ঠিক আছে।’

বাবার অনুমতি পেয়ে নতুন উদ্যমে আবার পুরনো বইগুলো পড়া শুরু করলেন। সময় মাত্র দুই মাস। কোনটা রেখে কোনটা পড়বেন কূল পাচ্ছিলেন না। চাকরির ধকল সহ্য করে এই দুই মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন উহ্লাচিং। ফলও পেলেন হাতেনাতে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট এবং গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন।

এখনো মেঘ কাটেনি

প্রকৌশলী ক্যসাচিং মারমাসহ কয়েকজনের সহায়তায় এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এখনো অনিশ্চয়তার মেঘ কাটেনি। নিজের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি সংসার কিভাবে চলবে—এই দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে এই তরুণকে। উহ্লাচিং বললেন, ভর্তি হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

করোনা ভাইরাসের কারণে বদলে গেছে আমাদের জীবন। আনন্দ-বেদনায়, সংকটে, উৎকণ্ঠায় কাটছে সময়। আপনার সময় কাটছে কিভাবে? লিখে পাঠাতে পারেন আমাদের। এছাড়া যেকোনো সংবাদ বা অভিযোগ লিখে পাঠান এই ইমেইলেঃ [email protected]