• বৃহস্পতিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ||

  • আশ্বিন ১৩ ১৪৩০

  • || ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

দৈনিক খাগড়াছড়ি

বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তৃতীয় পক্ষের এত মাতামাতি কেন?

দৈনিক খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২৩  

রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়

রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতির মাঠে দায় চাপানোর সংস্কৃতি বেশ পুরনো। নানা ঘটনায় কে দোষী আর কে নির্দোষ তা ও একপ্রকার ঠিক করে দেন এ অঞ্চলের স্থানীয় সংগঠনগুলো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা স্থানীয় প্রশাসনকে নানা ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করা হয়। বিভিন্ন সময়ে আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে নানা কর্মসূচীর নামে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এ অঞ্চলের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে অনেকেই স্বার্থ হাসিলের পাঁয়তারাও করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবার রাঙামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলার একটি ঘটনায় গত ২-৩দিন যাবৎ বেশ সরব হয়ে উঠেছে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা তথাকথিত কয়েকটি নারী সংগঠন। বিচারাধীন একটি বিষয়কে নিয়ে জল ঘোলা করে, স্থানীয় রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ানোর এ প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে নেটিজেনদের মাঝে। 

সংবাদ মাধ্যমেগুলোর বরাতে জানা যাচ্ছে, রাঙামাটির লংগদু উপজেলার করল্যাছড়ি রশিদ সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর অত্র বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এরপর শিক্ষার্থীর মা বাদী হয়ে লংগদু থানায় মামলা করলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে অভিযুক্ত আব্দুর রহিম। রাঙামাটি আদালত গত ২৯ নভেম্বর ২০২২ সালে আব্দুর রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং দশ লক্ষ টাকা জরিমানা করেন। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত থেকে ধর্ষিতা ওই ছাত্রীকে এক একর জমি লিখে দেওয়ার শর্তে ২১ জুন ২০২৩ তারিখে তিন মাসের জন্য অন্তর্বর্তী জামিন পান আসামী আব্দুর রহিম। ২২ জুন থেকে তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অজয় মিত্র চাকমার কাছে দন্ডপ্রাপ্ত শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি তোলেন। এরপর গত ১৪ আগস্ট স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভায় প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিমকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এরপরে স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর প্রভাবের কারনে প্রধান শিক্ষকের পদ হতে আব্দুর রহিমকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি তোলে কয়েকদফা মানববন্ধন ও মিছিল-সমাবেশ করে পাহাড়ের চুক্তিবিরোধী আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগী সংগঠন হিসেবে পরিচিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ। শুধুমাত্র মিছিল-সমাবেশে সীমাবদ্ধ থাকেনি তারা, হঠাৎ করে বুধবার (৩০ আগষ্ট) রাঙামাটিতে অর্ধদিবস  সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করে বসে। 

হঠাৎ করে এমন কর্মসূচী ঘোষনা করায় স্থানীয় সাধারণ খেটে খাওয়া পাহাড়ি ও বাঙালিরা ব্যাপক বিড়ম্বনার স্বীকার হয়েছেন। আতঙ্ক ছড়িয়েছে পুরো পাহাড়ে। নিত্যদিনের কাজে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লংগদু সদরের এক বাসিন্দা জানান, বুধবার রাঙামাটি জজ কোর্ট তার একটি জমি সংক্রান্ত মামলার শুনানী ছিল। এর প্রেক্ষিতে তিনি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নৌপথে রাঙামাটি চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এদিন দুপুরের আগে হঠাৎ করে অবরোধের ঘোষনা আসায় নৌ পরিবহন মালিকরা ভয়ে একদিন আগে থেকেই নৌপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। চাকমা সম্প্রদায়ের এই ভুক্তভোগী জানান, এর ফলে তার গত ১ বছর ধরে চেষ্টা করে যে প্রমানাধি কোর্ট হাজির করার কথা ছিল, তা আর হলোনা। এতে আর্থিকভাবেও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। 

নৌ পরিবহন মালিক ও চালক সমিতির একাধিক সদস্য এবং লংগদু-বাঘাইছড়ি সড়কে মাহিন্দ্র ও মোটরসাইকেল চালকরাও তাদের আতঙ্কের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াও, মারধর এমনকি গুলি করে মেরে ফেলার যে অতীত ইতিহাস এসব সংগঠনের রয়েছে, এতে করে আতঙ্কে তারা গাড়ি বা পরিবহণ নিয়ে রাস্তায় নামেন নি। যার ফলে অর্থনৈতিক ভাবে এসব খেটে খাওয়া মানুষজন ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। 

তবে, দাবি আদায়ের নানা গনতান্ত্রিক পন্থা থাকলেও হঠাৎ করে কেন একটি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এভাবে অবরোধের ডাক দেয়া হলো তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। ধর্ষনের মতো একটি জগন্য ঘটনার পর বাদী ও বিবাদী উভয়ে সম্মতিতে রাঙামাটি জজ কোর্টে একটি হলফনামায় স্বাক্ষর করে উভয়েই বিবাহের জন্য রাজি ও দুই লক্ষ টাকা দেনমোহরে বিবাহ সম্পন্ন করলেও হঠাৎ করে এ বিষয়ে কেন এই উত্তাপ ছড়ানো হচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে জোর সমালোচনা চলছে। 

ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় রাঙামাটির আদালত আসামীকে কারাদন্ড দিয়েছেন এবং জেল হাজতেও পাঠিয়েছেন। এরপর আসামী ও বাদী মিলে তাদের উভয়ের সম্মতিতে হলফনামা দিলে আসামী উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন। মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এমন সময়ে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এক সোরগোল করে বিচারকাজ প্রভাবিত করা হচ্ছে কি?

ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীরা আসামীকে বিদ্যালয় থেকে বহিস্কারের দাবি জানালে, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তাকে সাময়িক বহিস্কার করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবি যথাযথ পালন না হওয়ায় তারা বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে গত মঙ্গলবার বিকালে বিদ্যালয়ে উপজেলা প্রশাসন অভিভাবকদের সাথে জরুরি বৈঠকও করেন। বৈঠক থেকে শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কারের বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরাও বিদ্যালয়ে ফিরবে বলে অভিভাবকরা নিশ্চয়তা প্রদান করেন। বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, নৈতিকভাবে প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম শিক্ষকতা করার অধিকার তিনি হারিয়েছেন। আমরাও অভিভাবকদের দাবির সাথে একমত। আমরাও চাই তার শাস্তি হোক। তবে এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন। আদালতের রায়ে যা হোক না কেন বিভাগীয়ভাবে তাকে স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো। এতে করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের গনতান্ত্রিক ও নিরব প্রতিবাদ সফলতা পেল।

বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কার এবং নিম্ন আদালতের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় উচ্চ আদালতেও বহাল রাখার দাবিতে লংগদু উপজেলা সদরে মানববন্ধন করে করল্যাছড়ি রশিদ সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ আরো চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সমাজ। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের এমন দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে।  কিন্তু পক্ষান্তরে একটি আঞ্চলিক দলের পক্ষ হতে এ বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কারণ কি? অবরোধের নামে জেলার বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ বা হামলা করে তারা কি বার্তা দিতে চায় নিরীহ পার্বত্যবাসীকে? 

কোন বিষয়ে দাবি-দাওয়া থাকলে মানববন্ধন, সভা বা স্মারকলিপি প্রদানকেই আমরা দাবি আদায়ের অন্যতম গনতান্ত্রিক পন্থা বলেই জানি। কিন্তু অবরোধ, মারধর, জ্বালাও পোড়াও করে জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে এ কিসের আন্দোলন? সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীরা বলছেন, উচ্চ আদালত তো ধর্ষক আব্দুর রহিমের সাজা মাফ করে দেন নি বা তাকে মুক্তির আদেশও দেন নি। বাদীর হলফনামার প্রেক্ষিতে তাকে জামিন দিয়েছেন মাত্র। এ বিষয়টি নিয়ে কারো কোন অভিযোগ থাকলে আইনজীবির মাধ্যমে আদালতে আবেদন করলেই তো তার জামিন বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া বিচারের নামে জ্বালাও-পোড়াও ও জনদূর্ভোগ সৃষ্টিকারীদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। 

অন্যদিকে, বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামার গজালিয়ার ইউনিয়নে গত শুক্রবার (২৫ আগস্ট) এক তৃতীয় শ্রেণির চাকমা শিক্ষার্থীকে ধর্ষন করে আরেক চাকমা যুবক জ্যোতির্ময় চাকমা। এদিন ধর্ষিতা কিশোরীর মা বাড়ির কাজে বাহিরে গেলে একই পাড়ার বিজয় চাকমার ছেলে জ্যোতির্ময় চাকমা ঘরে ঢুকে এই কিশোরীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। আর এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে উক্ত কিশোরীর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে গত সোমবার (২৭ আগস্ট) দুপুরের পর তাকে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনা ঘটার ৪ দিন পর ওই  চাকমা কিশোরীর মা মঙ্গলবার বিকালে বাদী হয়ে লামা থানায় এই মামলা দায়ের করেছেন। 

কিন্তু এমন ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললেও এ বিষয়ে পাহাড়ের কোন আঞ্চলিক সংগঠনের অবরোধ তো দূরে থাক একটি বিবৃতিও চোখে পড়েনি কারো। স্বাজাতি হওয়ায় বরং ওই চাকমা যুবককে রক্ষায় কেউ কেউ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

করোনা ভাইরাসের কারণে বদলে গেছে আমাদের জীবন। আনন্দ-বেদনায়, সংকটে, উৎকণ্ঠায় কাটছে সময়। আপনার সময় কাটছে কিভাবে? লিখে পাঠাতে পারেন আমাদের। এছাড়া যেকোনো সংবাদ বা অভিযোগ লিখে পাঠান এই ইমেইলেঃ [email protected]