• বৃহস্পতিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ||

  • আশ্বিন ১৩ ১৪৩০

  • || ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

দৈনিক খাগড়াছড়ি

‘স্বর্গের সিঁড়ি’তে একদিন

দৈনিক খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ২৭ জুলাই ২০২৩  

হাতিমাথার ওপর থেকে তোলা।

হাতিমাথার ওপর থেকে তোলা।

দুর্গম পাহাড়ের মাঝ দিয়ে খাড়া সিঁড়ি। সেই পথ ধরে উঠতে হয় খাগড়াছড়ি হাতিমাথা পাহাড়ের চূড়ায়। স্থানীয়দের কাছে সেটি পরিচিত স্বর্গের সিঁড়ি নামে। দুর্গম পাহাড়ের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন রাকিব হাসান

‘ও তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা, ও তুই রাঙামাটির দেশে যা, এখানে তোকে মানাইছে নাই রে, ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে’– হেডফোন লাগিয়ে জনপ্রিয় এই পাহাড়ি গানটি শুনতে শুনতেই বাসে উঠলাম। গন্তব্য খাগড়াছড়ি। ঢাকার ফকিরাপুল থেকে বাস ছাড়ল রাত সাড়ে ১১টায়। পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি বৃষ্টির মধ্যে কতটা রোমাঞ্চকর হয় সে বিষয়ে আলাপ শুরু করলাম সফরসঙ্গী জয় কাকুর সঙ্গে। দু’দিনের ট্যুরে পাহাড়ের কোথায় কোথায় যাব তার ছক কষতে থাকলাম। তখনই সিদ্ধান্ত হলো, গতবার খাগড়াছড়ির যেসব দর্শনীয় জায়গায় যেতে পারিনি, এবার সেখান থেকেই শুরু হবে। মোটামুটি তিনটি জায়গায় যাব বলে ঠিক করলাম। এর মধ্যে অন্যতম ‘মায়ুং কপাল’ বা ‘হাতিমুড়া’। ত্রিপুরাদের কাছে এটি ‘এদো সিরে মন’ বলে পরিচিত আর হাতির মাথার মতো দেখতে বলে পর্যটকরা এটিকে বলেন ‘হাতিমাথা’। যাত্রাপথে কুমিল্লার একটি হোটেলে ২০ মিনিট বিরতি শেষে বাস ছুটতে শুরু করল খাগড়াছড়ির উদ্দেশে। ঢাকা-চিটাগং হাইওয়ের মিরসরাই করেরহাট থেকে বাঁ দিকে মোড় নিতেই জয় কাকু শক্ত করে সিট ধরে বসতে বললেন। কারণ এখান থেকেই পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা শুরু। এই রাস্তা ধরে সাড়ে ৩ ঘণ্টার রোমাঞ্চকর যাত্রা শেষে খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বরে পৌঁছালাম সকাল ৭টায়। আগে থেকেই হোটেল বুক করা ছিল। শহরের একটি হোটেলে হালকা নাশতা সারলাম। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমালাম। এরপর হোটেলে এলেন আমাদের পূর্বপরিচিত বন্ধু ও স্থানীয় বাসিন্দা মিলন ত্রিপুরা। পুরো সফরে তিনিই আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন দর্শনীয় সব স্থান। দেরি না করে হোটেল থেকে পিঠের ব্যাগে ক্যামেরা-মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক, গামছাসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাতিমাথার উদ্দেশে।

হোটেলের সামনে থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় মিলন দা আমাদের নিয়ে রওনা হলেন পানছড়ির দিকে। পথে জামতলীতে অটো থামাতে বললেন তিনি। তারপর নেমে বাঁ দিকের ইটের সলিং ধরে হাঁটতে বললেন। এখানকার এক দোকান থেকে আমরা পর্যাপ্ত পানির বোতল আর হালকা খাবার নিয়ে নিলাম। প্রায় ১০ মিনিট হাঁটার পর চেঙ্গী নদীর পাড়ে পৌঁছলাম। নৌকায় করে নদী পার হয়ে ঢুকে গেলাম আদিবাসী লোকালয়ে। সামনে মিলন দা, তার পিছু পিছু আমরা দু’জন হাঁটতে লাগলাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই লোকালয়ের পথে চলতে চলতে চোখ পড়ল এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা, খাবার আর সংস্কৃতি। পাহাড়ি বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, পাশের ফাঁকা জমিতে নারীরা জুম চাষ করছেন, গাছে গাছে নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখর। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে যতটা কষ্ট হচ্ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক প্রশান্তি পাচ্ছিলাম প্রকৃতির এমন সান্নিধ্য উপভোগ করে।

চলার পথে ২-৩টি বাঁশের সাঁকো পেরোনোর পর উঁচু-নিচু পাহাড় দেখা যাচ্ছিল দূরে। মনে হচ্ছিল গন্তব্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। মিলন দা বললেন, পাহাড়ে পথ খুব কাছে মনে হলেও হেঁটে যেতে বেশ সময় লাগে। কথা শুনে গলা শুকিয়ে গেল! ধপাস করে বসে পানি খেতে শুরু করলাম। তারপর ১০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। চোখে পড়ল এখানকার মানুষের সংগ্রামী জীবন। কত কষ্ট করে তারা পাহাড়ের বুক চিরে ফসল ফলান, সেই ফসল নিজেরা খান আর কিছু বিক্রি করে সংসার চালান। মনটা বিষণ্ন হলেও চোখ ঘুরিয়ে প্রকৃতির মায়ায় পড়ে গেলাম। ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেকটা উঁচুতে চলে এসেছি আমরা এতক্ষণে। এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। ওপরের আকাশটা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, কখনও মেঘ কেটে নীলিমা উঁকি দিচ্ছে। নয়নাভিরাম এই সৌন্দর্য কিছুক্ষণের জন্য আমাকে আর জয় কাকুকে থমকে দিল। পরে ফোন আর ক্যামেরা বের করে বেশ কিছু ছবি আর ভিডিও নিয়ে নিলাম। এক পর্যায়ে মিলন দা বলে উঠলেন, ‘কী দাদারা, আরও অনেক পথ যেতে হবে।’

আরও কিছু দূর পাহাড়ি খাড়া পথ বেয়ে ওপরে উঠে একটা দোকান চোখে পড়ল। সেখান থেকে ডাব আর পাহাড়ি আম খেলাম সবাই। তারপর আবার হাঁটা শুরু। এতক্ষণে আমাদের শরীর ঘেমে জামা-প্যান্ট সব ভিজে গেছে। অবশ্যই পাহাড়ে ঘুরতে গেলে হালকা জামাকাপড় পরা উচিত সবার। আমরা এই ভুল না করলেও ট্র্যাকিংয়ের জন্য ভালো গ্রিপওয়ালা জুতা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম, যার মাশুল দিতে হলো গন্তব্যের আগমুহূর্তে হুট করে যখন বৃষ্টি নামল তখন। পাহাড়ি মাটি-পাথর বৃষ্টির ছোঁয়া পেতেই পিচ্ছিল হতে শুরু করল। তখন পথ বেশ দুর্গম মনে হলো। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যেতেই দূর থেকে চোখে পড়ল কাঙ্ক্ষিত হাতিমাথা। চলার পথের দুই পাশেও পাহাড় আর পাহাড়। এর ভেতরেও আদিবাসী নারী-পুরুষকে কাজ করতে দেখা গেল। চোখ জুড়িয়ে গেল জুম চাষ দেখে। ধান, কলা, আনারস থেকে শুরু করে শাকসবজিও চাষ হয় এত উঁচু পাহাড়ে। এর মাঝ দিয়ে হেঁটে চলে এলাম গন্তব্যে।

হাতিমাথা কাছ থেকে দেখেই লাফিয়ে উঠলাম। সম্ভবত পাহাড়ের ওপর এত সুন্দর সিঁড়ি দেশে আর কোথাও নেই। অনেকের কাছে এটি স্বর্গের সিঁড়ি হিসেবেও পরিচিত। বহু নামের অধিকারী হাতিমাথা পাহাড়ের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অনেক গ্রামের বাসিন্দা চলাচল করেন। গ্রামবাসীর চলাচলকে সুবিধাজনক করতে এই পাহাড়ে ৩০৮ ফুট লম্বা লোহার সিঁড়ি তৈরি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এই সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে থাকলাম। উচ্চতা ভীতি থাকার পরও শক্ত হাতে রেলিং ধরে নিচে না তাকানোর চেষ্টা করলাম। একেবারে শেষভাগে এসে খাড়া সিঁড়ি দেখে ভয়ও লাগছিল, আবার গন্তব্য শেষ করার নেশাও পেয়ে বসছিল। ধীরে ধীরে আমার গণনায় ৩১৫টা সিঁড়ি শেষ করে চলে এলাম এক্কেবারে ওপরে। ওপর থেকে এত সুন্দর পৃথিবী আগে দেখিনি। জয় কাকু অবশ্য আমার সঙ্গে ওপরে ওঠেননি। তবে মিলন দা আমার পিছু পিছু এসে কিছু ছবি তুলে দিলেন। হাতিমাথা পাহাড়ের এই চূড়া থেকে দূরের খাগড়াছড়ি শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এ ছাড়া চারপাশের সবুজে মোড়ানো পাহাড়ি প্রকৃতি, মেঘের লুকোচুরি খেলা এবং আদিবাসী জীবনধারার বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা পেতে পর্যটকদের কাছে হাতিমাথা বা হাতিমুড়া ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বৃষ্টির মধ্যে এখানে না আসা উত্তম। খুব সতর্ক এবং সাহসী না হলে দুর্ঘটনা হতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। সবশেষে এখান থেকে নামাও একটা ঝুঁকির ব্যাপার, পদে পদে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সে যাই হোক, পাহাড়ের এত ওপর থেকে এমন সৌন্দর্য উপভোগের পর আমাদের শরীরের ক্লান্তি যেন নিমেষেই হাওয়ায় মিশে গেছে। এবার হোটেলে ফেরার পালা।

যেভাবে যাবেন 

ঢাকার বিভিন্ন বাস পয়েন্ট থেকে শান্তি, হানিফ, সেন্টমার্টিন পরিবহন, গ্রিন লাইন পরিবহন, রবি এক্সপ্রেস, ঈগল এবং শ্যামলী পরিবহনের এসি বা নন-এসি বাস খাগড়াছড়ি যায়। বেশির ভাগ বাস ঢাকা-খাগড়াছড়ি যাতায়াত করে সকালে এবং রাতে। শান্তি পরিবহনসহ ২-১টি অপারেটর দিনের অন্যান্য সময়ও চলাচল করে। এসব বাসে নন-এসি ৭০০-৭৫০ টাকা টিকিট জনপ্রতি। এসি গাড়ির প্রকারভেদে জনপ্রতি ১০০০-১৬০০ টাকা ভাড়া।

যেখানে থাকবেন

খাগড়াছড়ি শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলের মধ্যে হোটেল গাইরিং, নূর হোটেল, পর্যটন মোটেল অন্যতম। ছুটির মৌসুম বা ছুটির দিনে আগে থেকেই হোটেল বুক করা ভালো। অন্য সময় হলে খাগড়াছড়ি পৌঁছে দরদাম করে হোটেল বুক করতে পারেন। এক বেডের নন-এসি রুম ৮০০-১০০০ টাকা নিতে পারে। ডাবল বেডের নন-এসি রুম ১৮০০-২০০০ টাকা আর সিঙ্গেল এসি রুম ১৫০০-২০০০, ডাবল বেডের এসি রুম ২৫০০-৩৫০০ পর্যন্ত নিতে পারে। এসব আবাসিক হোটেলের আশপাশেই বিভিন্ন বাঙালি এবং আদিবাসী হোটেল-রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন প্রকার বাঙালি ও আদিবাসী খাবার খেতে পারেন।

করোনা ভাইরাসের কারণে বদলে গেছে আমাদের জীবন। আনন্দ-বেদনায়, সংকটে, উৎকণ্ঠায় কাটছে সময়। আপনার সময় কাটছে কিভাবে? লিখে পাঠাতে পারেন আমাদের। এছাড়া যেকোনো সংবাদ বা অভিযোগ লিখে পাঠান এই ইমেইলেঃ [email protected]