শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||
চৈত্র ১৫ ১৪৩০
|| ১৮ রমজান ১৪৪৫
দৈনিক খাগড়াছড়ি
প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২০
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এর স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে এক ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তৎকালীন পার্বত্য শান্তিচুক্তির জাতীয় কমিটির আহবায়ক ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আর এই চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের জাতিগত হানাহানি অবসানের মধ্য দিয়ে অনগ্রসর এবং অনুন্নত পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের ধারা প্রবাহিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশক ধরে চলা সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ করে অস্ত্র সংবরণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে পাহাড়ে আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র গেরিলারা।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চাকমা রাজার প্রতিনিধি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে পাল্টা বাঙালিকরণের প্রস্তাব করেন। এমনকি, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটির জনসভায় পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন। তিঁনি বলেন, ‘তোমরা সবাই বাঙালি হইয়া যাও। আমি তোমাদের উপজাতি থেকে জাতিতে প্রমোশন দিলাম’। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর পাল্টা দাবি নাকোচ করে দেন। শুধু তাই নয়, তারা চাকমা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে জনসংহতি সমিতি এবং ১৯৭৩ সালে তাদের সামরিক শাখা শান্তি বাহিনীও গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সমস্যাটি এভাবেই চলছিল এবং তেমন আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাতে তৎকালীন পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ, আরও সংঘাতময় করে তোলে। দিনের পর দিন শান্তি বাহিনীর চোরাগুপ্তা হামলায় আমাদের বাংলাদেশি অনেক সৈনিক সেখানে তখন শহীদ হয়েছে। জিয়াউর রহমান ভেবেছিলো, অস্ত্রের মুখে শান্তি বাহিনীর সকল আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিবে। কিন্তু তার ওই সিদ্ধান্ত বরং আরও রক্তপাতের সূচনা ঘটায়, হিতে বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর পার্বত্য অঞ্চলে দিনের পর দিন শান্তি বাহিনীর হামলায় আমাদের প্রচুর সৈনিকের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
আরেক অবৈধ স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদও অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতির কিছুটা পরিবর্তন করেন। ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার ৩টি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করে তাদের হাতে কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করেন। তারপরেও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তারা সশস্ত্র আন্দোলন বন্ধ করেনি। উপজাতীয়রা কখনও স্বায়ত্ত শাসন, কখনও বাঙালি খেদাও প্রভৃতি দাবিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবতারনা করেন।
রাজনৈতিক অনেক চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পার্বত্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে জাতীয় কমিটি গঠন করে উপজাতীয় প্রধানের সাথে আলোচনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে ১ম দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং ২৬ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির খসড়া প্রণয়ন করেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
নানাবিধ সমস্যার মাঝেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলও ফুটে উঠেছে পাহাড়ি অঞ্চলে। পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-মান উন্নয়নের নানান পদক্ষেপ-এর আলোর ছড়িয়ে পড়েছে। দূর্গম পাহাড়ে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সন্তানদের যেমন শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হচ্ছে তেমনি তাদের পরিবারদেরও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সার্বিকভাবে সচ্ছল করে তোলা হচ্ছে। যাতে করে দূর্গম পাহাড়ে থেকেও সমাজের মূল স্রোতের সাথে বাস্তব অর্থেই অনায়াসে মিশতে পারে এবং আধুনিক বিশ্বায়নে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে তাই দেশের একদশমাংশ জায়গা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ও রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। আর শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহলের দাবি থেকে স্পষ্ট যে, চুক্তিটির গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ পদক্ষেপগুলো অবশ্যই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ। বিশেষ অঞ্চল বলেই দেশের মধ্যে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে। একজন প্রতিমন্ত্রী সেখানকার সব বিষয় দেখভাল করছেন। ১৪৫টিরও বেশি এনজিও পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের সব উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কেবল শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে।
করোনা ভাইরাসের কারণে বদলে গেছে আমাদের জীবন। আনন্দ-বেদনায়, সংকটে, উৎকণ্ঠায় কাটছে সময়। আপনার সময় কাটছে কিভাবে? লিখে পাঠাতে পারেন আমাদের। এছাড়া যেকোনো সংবাদ বা অভিযোগ লিখে পাঠান এই ইমেইলেঃ [email protected]
দৈনিক খাগড়াছড়ি Dainik Khagrachari
সর্বশেষ
জনপ্রিয়